জীবন বাঁচাতে মিয়ানমারের জনপ্রতিনিধিরাও বাংলাদেশে
জীবনের ত্রিশটি বছর জনগণের সেবা করেছি। সুখে-দুঃখে, বিপদ-আপদে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। কখনও বাবা, কখনও ভাই, কখনও চাচা, কখনও মামা হয়ে অসহায় মানুষদের আশ্রয় দিয়েছি নিজের জায়গায়। আত্মীয়স্বজনের মতোই মিলেমিশে কাটিয়েছি জীবনের ৫৭টি বছর। কখনও আপন-পর ভেদাভেদ করিনি।
রোহিঙ্গা হলেও মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে ভালোই ছিলাম এতদিন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অত্যাচার-নির্যাতন চালালেও দেশ ছাড়ার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি আগে কখনও। কোনোদিনও ভাবিনি নিজের জন্মভূমি, সহায়-সম্পত্তি, সবকিছুর মায়া ছেড়ে পরবাসী হয়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিতে হবে। কিন্তু ২৭ ও ২৮ আগস্ট মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং কালো পোশাক পরিহিত রাখাইন বৌদ্ধদের হঠাৎ হামলায় সবকিছুই এলোমেলো করে দিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজের সন্তান এবং ছোট ভাইসহ গ্রামের অসংখ্য পুরুষকে বেঁধে ফেলে কালো পোশাকধারী লোকেরা। পেছনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীও ছিল। চোখের সামনেই নিজের সন্তান এবং ছোট ভাইসহ অসংখ্য পুরুষকে গুলি করে, গলা কেটে হত্যা করা হয়। আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয় গ্রামের সব বাড়িঘর। সোমবার কথাগুলো বলেন মিয়ানমারের ডেকুবুনিয়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান দিল মোহাম্মদ।
চাকঢালা বড়ছনখোলা আশ্রয় ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া এ জনপ্রতিনিধি বলেন, ২৭ বছর বয়সে তিনি প্রথম ইউপি চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। ৩০ বছর ধরে তিনি ওই ইউপির চেয়ারম্যান। পারিবারিকভাবে কাপড়ের ব্যবসা ছিল তাদের। ছিল দুইশ’ কানি ধানী জমিও। জমির ধান কাটার সময় এখন। মোটামুটি পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখেই ছিলাম। কিন্তু ২৭ ও ২৮ আগস্ট মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং কালো পোশাকধারী রাখাইন বৌদ্ধদের হামলা-নির্যাতনের চিত্রটা এতটা ভয়াবহ আর নৃশংস ছিল, যে প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গাদের স্রোতের সঙ্গে দুর্গম পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে নিজেও এখন বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছি। জানিনা, নিজের দেশে আর ফিরতে পারব কিনা? পরিবারের অন্য কোনো সদস্য বেঁচে আছেন কিনা। নিজের দেশ, সহায়-সম্পতি, আত্মীয়-পরিজন কিছুই আজ নেই। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং রাখাইন উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা হঠাৎ কেন এমন নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন চালাচ্ছে তা জানি না।
মিয়ানমারের তুমব্রু উত্তর ইউপি চেয়ারম্যান আহমদ উল্লাহ বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আমাদের জন্ম। বাপ-দাদা পূর্বপুরুষদের আমল থেকেই রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যের বাসিন্দার। সরকারের দমন-নিপীড়ন পূর্বপুরুষের আমলেও ছিল। রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকারও ছিল। কিন্তু রোহিঙ্গা ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। শুধু পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করার সুযোগ ছিল। সেটিও বার্মিজ ভাষায়। সরকারি কোনো চাকরির সুযোগ নেই রোহিঙ্গাদের। কৃষিনির্ভর জীবন-যাপন ছিল রোহিঙ্গাদের। তারপরও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে ভিটেমাটি কেড়ে নেয়া হল। মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছি বাংলাদেশে। পরের দেশ তারপরও এখানে জীবনের নিরাপত্তা আছে। খাবার আর থাকার কষ্ট থাকলেও স্ত্রী-সন্তানকে হারানোর ভয় নেই। তবে পরিস্থিতি শান্ত হলে আবারও নিজের দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাব। অন্যের দেশে পরবাসী হয়ে থাকতে চাই না। নিজের দেশ মিয়ানমারে ফিরতে চাই।